আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান।
Published: 2021-04-13 07:30:00
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহা সওগাতের মাস মাহে রমজান। মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের অন্যতম নিয়ামত হলো মাহে রমজানের রোজা ও পবিত্র শবে কদর। কাম- ক্রোধ, কামনা- বাসনা ও পশু- প্রবৃত্তির অবসান ঘটিয়ে ক্ষুদ্র মানব সত্ত্বা মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের অপূর্ব সোপান হলো রোজা। অনাবিল শান্তি, সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সমৃদ্ধময় সুষম সমাজ গঠনে রোজার ভূমিকা চির অনস্বীকার্য।
রোজার উদ্দেশ্য :রোজা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষণা, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সিয়াম সাধন করা বাধ্যতামূলক করা হলো, যেমন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” বস্তুত আত্মশুদ্ধি বা তাকওয়াই হলো রোজার মূল্য উদ্দেশ্য।
তাকওয়া অর্জন : তাকওয়া অর্থ হলো বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে অন্যায় থেকে বিরত রাখা। বিশেষত মহান আল্লাহর ভয়ে সকল প্রকার অন্যায় অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থেকে তারই নির্দেশিত পথে অবিচলচিত্তে চলার নামই হলো তাকওয়া। মুসলমান পাপ-পঙ্কিলময় সমাজে বাস করবে বটে, তবে পাপ-পঙ্কিলতা তাকে স্পর্শ করবে না। আর এমন ধরনের মুত্তাকী হওয়ার জন্যই আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। “ হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর, যেমন তাকে ভয় করা উচিত (সুরা আল ইমরান ১০২)।” অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “ তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর (সূরা তাগাবুন ১৬)।” আর এ তাকওয়ার গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন, আল্লাহ বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন (সূরা তওবাহ - ৪)।” ব্যক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ও মুহূর্তে মহান আল্লাহকে ভয় ও তার নিকট জবাবদিহি অনুভূতি সৃষ্টির জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে।
আত্মসংযম সৃষ্টি : মানুষের মাঝে রয়েছে জৈবিক ও পাশবিক শক্তি। পাশবিক শক্তি মানুষকে স্বেচ্ছাচারিতার পথে পরিচালিত করে, আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে মানব সমাজে দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়-বিবাদ ও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার ফলে সমাজে অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। রোজা সংযম শিক্ষা দেয় এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দীর্ঘ এক মাস ট্রেনিং দ্বারা নফস বা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। আর মনুষ্য প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত থাকলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি, শৃঙ্খলা, সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় থাকে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল : মানুষ জৈবিক চাহিদার কারণে অনেক সময় বিপথগামী হয়। আর বিপথগামিতার ফলে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য। রোজা সে অন্যায় ও ধ্বংস হতে রক্ষার জন্য ঢাল স্বরূপ। ঢাল যেমন সৈনিককে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করে তেমনি রোজা মানুষকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখে। রাসূল (সা.) বলেন, “রোজা ঢাল স্বরূপ।’
সমবেদনা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি: যারা বিত্তশালী ধনাট্য সম্প্রদায়, যাদের রয়েছে খাদ্য পানীয়ের প্রাচুর্য তাদের পক্ষে ক্ষুধার্তের কঠিন জ্বালা উপলব্ধি করা কঠিন। কিন্তু যখন রমজানের সিয়াম সাধনা করে তখন তারা ভুখা নাঙা-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের ব্যথা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারে। যখন কোন ভিক্ষুক এসে তার দ্বারে উপস্থিত হয় তখন সে তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে ইতস্তত বোধ করে।
ধৈর্য্যধারণ : ধৈর্য্যই সফলতার চাবি, ধৈর্য্য মুমিনের উত্তম গুণ। ধৈর্যশীল হওয়ার জন্য আল -কুরআনে বারবার তাকিদ এসেছে। “ হে ঈমানদারগণ, তোমরা সবর করো এবং সবরের প্রতিযোগিতা করো (সূরা ইমরান -২০০)।” রোজা সেই ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠার বহিঃপ্রকাশ। ক্ষুৎপিপাসা এবংযৌনাকাঙ্ক্ষাটা যে কোন সময়ে জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু রোজা সে কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। হাদীসে এসেছে, “রোজা সবরের অর্ধেক এবং সবর বা ধৈর্য্য ঈমানের অর্ধেক।”
সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি : রোজার মাধ্যমে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। সবাই একসাথে একই সময়ে সেহরি খাই, ইফতার করে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একসাথে এবাদত-বন্দেগী করে। ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত সবার মুখমন্ডল শুকিয়ে যায় এক আল্লাহর জন্য।
সময়ানুবর্তিতা : রোজা সময়ানুবর্তিতার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেষ রাতে নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, সালাতুল ফজর আদায়, , নির্দিষ্ট সময়ে আবার ইফতার ও মাগরিবের নামাজ আদায়, তারপর আবার এশা ও তারাবীহর নামাজ আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ সময়ানুবর্তী রূপে গড়ে ওঠে।
অহংকার মুক্ত জীবন গঠন : রোজার মাঝে কোন অহংকার রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা নেই। রোজার নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যেই। অনুরূপভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই রিয়া বর্জন করে খালেছ- ভাবে আল্লাহর কাছে ইবাদত করার জন্য শিক্ষা দিয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, রোজা মহান আল্লাহর এক অফুরন্ত নিয়ামত। নৈতিক আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার মানবিক গুণাবলী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বিকশিত হয়। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়।